বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:০৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ডিজিটাল থেকে সাইবার নিরাপত্তা

রাজেকুজ্জামান রতন:

বাংলাদেশে কোনো আইন প্রণয়ন, প্রণয়ন-পরবর্তী প্রয়োগ নিয়ে এত আলোচনা, বিতর্ক এবং আতঙ্ক আর হয়েছে কিনা জানা নেই। আইন ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে নিবর্তন ও নির্যাতনের রেকর্ড এ রকম আছে কিনা সন্দেহ। মামলা তো বটেই, শিশু গ্রেপ্তার, সাংবাদিক গ্রেপ্তার, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে গ্রেপ্তারের এত নজির সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। এসবই ঘটেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে। সেই বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করেছে মন্ত্রিসভা। কিন্তু এই খবরে স্বস্তি পাওয়ার আগেই শোনা গেল যে, একই সঙ্গে সরকার ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ নামে নতুন আরেকটি আইনের ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ আগের আইনটি প্রতিস্থাপনের কাজ চলছে। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সংশোধনও না, রহিতও না; এটি পরিবর্তন করা হয়েছে। আইনের ব্যাপ্তি বাড়ানোর জন্যই নামটি রাখা হয়েছে সাইবার সিকিউরিটি আইন। তার কথার সহজ অর্থ দাঁড়ায়, আইনের ব্যাপ্তি বাড়ছে। এতে কি আতঙ্ক বাড়বে না কমবে?

একটু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এ ধরনের আইন করার প্রক্রিয়াটা একেবারে নতুন না। ২০০৬ সালে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও বিচারের জন্য বিএনপি-জামায়াত সরকার তথ্যপ্রযুক্তি তথা আইসিটি আইন করেছিল। কিন্তু আইন প্রণয়নের পর তার প্রয়োগ করার কাজটা থমকে ছিল। ২০১৩ সালে সাইবার আইনের আওতায় করা মামলা বিচারের জন্য প্রথম ঢাকায় সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আওয়ামী লীগ। আইসিটি আইন নিয়ে সমালোচনার মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৮ সালে প্রণয়ন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এরপর শুরু হয়ে যায় মামলার বন্যা। মামলা পরিচালনার জন্য ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল বাকি সাত বিভাগীয় শহরে সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের গোপনীয় শাখার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ৮টি বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে ৫ হাজার ৫১২টি মামলা বিচারাধীন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল ৭ হাজার ৬৬৪টি।

সাংবাদিক, আইনজীবী এবং বিরোধী রাজনৈতিক মহল প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেরও সমালোচনা করছেন। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘যারা সমালোচনা করছেন এবং নতুন বোতলে পুরনো মদ বলছেন তারা আইনটি না পড়ে এসব বলছেন। তার আরও বক্তব্য ছিল যে, সমালোচনাকারীরা সরকারের কোনো পদক্ষেপকেই ভালো মনে করেন না। কিন্তু সরকার দেশের জন্য যা ভালো তাই করে।’ প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ার সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দুই আইনের মধ্যে শাস্তি কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে। মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের অপরাধের ক্ষেত্রে আর কারাদণ্ড নয় শুধু জরিমানা হবে।

নতুন আইনের খসড়ায় মোট ধারা ৬০টি, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল ৬২টি। প্রস্তাবিত আইনে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমবারের জন্য যে সাজা, বারবার করলেও একই সাজা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে সাজা বেশি রাখার বিধান ছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মনে করে, তা সংশোধনের দাবি করেছিল সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ। প্রস্তাবিত আইনে এ ক্ষেত্রে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে কিছুটা সংশোধন আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, আর দুটি ধারায় কোনো পরিবর্তনই আনা হয়নি।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের দপ্তর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (২১ ও ২৮) বাতিলের কথা বলেছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে আগের মতোই বিষয়বস্তু হুবহু বহাল রাখা হয়েছে। ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার জন্য দণ্ডের বিধান রয়েছে। এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। প্রস্তাবিত আইনে শুধু সাজা কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে। তবে অর্থদণ্ড আগের মতোই ১ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন বা ৩ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। প্রস্তাবিত আইনে এটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাতসংক্রান্ত বিষয় রয়েছে। নতুন আইনেও এটি রয়েছে। কী হলে অনুভূতিতে আঘাত লাগে সে বিষয়ে অস্পষ্টতা দূর করা হয়নি। সংখ্যালঘুরা কি কখনো অনুভূতিতে আঘাত পায়? এই ধারায় অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। প্রস্তাবিত আইনে এই অপরাধের সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছর বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দ- হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি অপরাধের বিষয়ে বলা ছিল। এই অপরাধের শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। এখন সাজা দুই বছর এবং জরিমানার পরিমাণ থাকছে একই।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান ছিল। এখন এই অপরাধের জন্য কারাদণ্ডের বিধান বাদ দিয়ে শুধু জরিমানা করার বিধান যুক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারায় বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো বা ঘটার উপক্রম-সংক্রান্ত অপরাধের উল্লেখ ছিল। এই ক্ষেত্রেই ঘটেছিল সবচেয়ে বেদনাময় ঘটনাগুলো। নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। কিন্তু অর্থদণ্ড বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল। প্রস্তাবিত আইনে কারাদণ্ড সর্বোচ্চ সাত বছর বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে।

৩২ ধারায় শাস্তির মাত্রা কিছু কমানো হলেও ঔপনিবেশিক আমলের ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে রেখে দেওয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী এ দেশের মানুষকে তথ্য জানতে দিতে চাইত না বলে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন জারি করেছিল। স্বাধীন দেশে এই আইন থাকার যুক্তি কী? সম্পাদক পরিষদ ও জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু একই থেকে গেল। পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার সংক্রান্ত এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বিশ্বাস করেন যে, কোনো স্থানে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বা সাক্ষ্য-প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা, পরিবর্তন বা অন্য কোনো উপায়ে দু®প্রাপ্য হওয়ার বা করার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে ওই কর্মকর্তা বিশ্বাসের কারণ লিখে ওই স্থানে তল্লাশি এবং বাধাপ্রাপ্ত হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। তিনি তল্লাশিকালে পাওয়া অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত বা অন্যান্য সরঞ্জামাদি এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক কোনো দলিল জব্দ করতে পারবেন। এমনকি ওই স্থানে উপস্থিত যেকোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি, সন্দেহ হলে গ্রেপ্তার করতে পারবেন। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধারা বহাল থাকছে সাইবার নিরাপত্তা আইনেও।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন ও সম্পাদক পরিষদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৫৩ ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছিলেন। এতে জামিনযোগ্যতার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ধারা ছিল ১৪টি। এই ধারাগুলো হলো ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ এবং ৩৪ ধারা। এখান থেকে ৮টি ধারা প্রস্তাবিত আইনে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এগুলো হলো ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৩৪ ধারা। অন্যদিকে প্রস্তাবিত আইনে অজামিনযোগ্য ধারা ৬টি। এগুলো হলো ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩। জামিনযোগ্য ও অজামিনযোগ্য ধারার বিষয়টি প্রস্তাবিত আইনের ৫২ ধারায় রয়েছে।

অপরাধের সংজ্ঞায় পরিবর্তন না করায় প্রস্তাবিত আইনটাও নিপীড়নের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করার সুযোগ থেকে গেল। কারণ অপরাধ সম্পর্কে অনেক ঢালাওভাবে বলা আছে। ফলে চাইলেই যার-তার বিরুদ্ধে যেকোনো কিছু বলা ও লেখার জন্য মামলা করা যাবে। আগের তুলনায় পার্থক্য হলো এই যে, মামলার পর বিচারে শাস্তি কিছুটা কম হবে। কিন্তু লেখার কারণে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার যে ভয়, অপরাধী বানানোর যে সুযোগ তা তো থেকেই গেল। মানহানি, চেতনায় আঘাত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার নামে কত যে হয়রানি হয়েছে সেসব মনে পড়লে লিখতে গেলে ভয় তো পাবেই। আইন মন্ত্রী বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো এই আইনের অপব্যবহার হবে না। স্বীকারোক্তি দিলেন কিন্তু মানুষ এতে স্বস্তি পাবে কি?

সন্দেহের কারণ এই যে, আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ও মানসিকতাটা আগের মতোই। নিবর্তনমূলক ধারাগুলো বহাল রেখে এই আইনকে নতুন আইন বলা যাবে কি? নাকি বোতলটা পুরনো, মদটাও পুরনো শুধু লেবেলটা নতুন। বরং এই আইন মতপ্রকাশকে কঠোর নজরদারির জালে আটকে ফেলবে।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট

rratan.spb@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION